"ক্লিন সিটি, গ্রীন টুমোরো" শিরোনামে পরিবেশবিদ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (বা.প.ই) কতৃক বিশ্ব পরিবেশ দিবস, ২০২৫ পালিত

 

ছবি: ওয়েবিনারে উপস্থিতির একাংশ

বর্তমান বিশ্বে পরিবেশের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ দূষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো প্লাস্টিক দূষণ। প্রতিদিন আমাদের জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত নানা পণ্য যেমন- বাজারের ব্যাগ, বোতল, মোড়ক, খেলনা ইত্যাদি সবকিছুতেই প্লাস্টিকের প্রাধান্য বেড়েছে। অথচ এই প্লাস্টিকই হয়ে উঠেছে মানবসভ্যতা ও প্রাকৃতিক পরিবেশের এক ভয়ঙ্কর শত্রু। এই প্লাষ্টিক দূষণকে কেন্দ্র করে পরিবেশবিদ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (বা.প.ই), একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করেছিল ৫ জুন, ২০২৫, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে।

আয়োজনে মূল উপস্থাপনা প্রদান করেন পরিবেশবিদ জনাব মাহামুদুর রহমান পাপন, সাধারণ সম্পাদক, বা.প.ই। উপস্থাপনায় তিনি জানান, প্লাস্টিক বর্জ্য শত বছরেও পচে না। এটি জমে জমে মাটির উর্বরতা হ্রাস করে, পানির প্রবাহ বন্ধ করে এবং সমুদ্র ও নদীর বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেয়। প্লাস্টিকের অতিক্ষুদ্র কণা, যাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়, তা বাতাস, পানি, এমনকি খাদ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে মানুষ ও প্রাণী উভয়ের শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। নদী ও সমুদ্রে ফেলা প্লাস্টিকের কারণে বহু সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে, তারা প্লাস্টিককে খাবার ভেবে খেয়ে ফেলে, যা তাদের পাচনতন্ত্রে বাধা সৃষ্টি করে। প্লাস্টিক দূষণের কারণে মানবস্বাস্থ্যে নানা ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দেয়। খাদ্য, পানি ও বাতাসের মাধ্যমে প্লাস্টিকের অতিক্ষুদ্র কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) দেহে প্রবেশ করে অন্ত্র, যকৃত ও মস্তিষ্কে ক্ষতি করে। এছাড়া প্লাস্টিক উৎপাদনে ব্যবহৃত রাসায়নিক হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, যার ফলে বন্ধ্যাত্ব, জন্মগত ত্রুটি ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। অপরদিকে, প্লাস্টিক পোড়ালে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ফুসফুসের মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করে। পাশাপাশি, প্লাস্টিক দূষণ অর্থনীতির উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিকে ঢেকে যাওয়া সমুদ্র, নদী বা পার্ক পর্যটকদের আকর্ষণ হারায়, ফলে স্থানীয় ব্যবসা ও কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। শহর পরিষ্কার রাখতে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত জনবল, যন্ত্রপাতি ও অর্থ, যা পরিচ্ছন্নতা ব্যয় বাড়িয়ে তোলে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে এবং রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোর ক্ষতি করে, যার মেরামতে সরকারকে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়। পাশাপাশি, মাটি ও পানির মান নষ্ট হয়ে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন কমে যায়, যা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

Source: Map of the Week: Plastic Pollution by Country 2024

প্রধান উপস্থাপক পরবর্তীতে প্লাষ্টিক দূষণ মোকাবেলায় করণীয় কি তা উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, প্লাস্টিক দূষণ থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন বহুমুখী ও সমন্বিত উদ্যোগ। ব্যক্তি ও সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবেএকবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পরিহার করে পাট বা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারকে উৎসাহ দিতে হবে। ব্যবহৃত প্লাস্টিক আলাদা করে সংরক্ষণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ নিশ্চিত করতে হবে, স্থানীয় পর্যায়ে রিসাইক্লিং প্লান্ট স্থাপন এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আইন প্রয়োগ ও সরকারি নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন দরকারযেমন পাতলা পলিথিন নিষিদ্ধকরণ এবং পরিবেশবান্ধব পণ্যে কর ছাড়। পরিবেশবান্ধব বিকল্প উদ্ভাবনের জন্য গবেষণায় বিনিয়োগ এবং জুট বা বেতের মতো প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে নতুন পণ্য তৈরি করা উচিত। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনতা কর্মসূচি ও স্থানীয় পর্যায়ে ক্লিনআপ অভিযান চালানোর মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলা আরও কার্যকর করা সম্ভব।

ওয়েবিনারে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের, স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রাক্তন প্রধান স্থপতি ও বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট এর প্রাক্তন সভাপতি, স্থপতি জনাব কাজী নাসির। তিনি বলেন, যেহেতু প্লাস্টিকগুলি দীর্ঘ-শৃঙ্খল রাসায়নিক অণু দ্বারা গঠিত, তাই রসায়নবিদদের পক্ষে কি এমন একটি প্রতিক্রিয়াশীল যৌগ তৈরি করা সম্ভব কিনা, যা প্লাস্টিকের সাথে বিক্রিয়া করে প্লাস্টিককে দ্রবীভূত করতে সক্ষম। সেই সাথে তিনি আরো উল্লেখ করেন, এই ধরণের জনসচেতনতামূলক আলোচনায় যদি নীতিনির্ধারকদেরকেও উপস্থিত করা যেত তাহলে আইন ও নীতিনির্ধারণীর বিষয়গুলোকে আরো সহজে তাদের সামনে তুলে ধরা যেত। আলোচনায় এই প্রাক্তন প্রধান স্থপতি তার কর্ম জীবনে দেখা বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার ও ব্যবহার পরবর্তী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন।

ওয়েবিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ পরিবেশবিদ ইনস্টিটিউট এর অন্তরজাতিকে বিষয়ক সম্পাদক, জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র বিষয়ক সম্পাদকLGED 'র প্রকৌশলী ও 3C Engineering & Research এর মুখপাত্র জনাব তাহমিদ সহ LGED এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত একাধিক প্রকৌশলী, স্থপতি, পরিবেশবিদগণ। আলোচনার পরিশেষে সকলেই একমত হন যে, প্লাস্টিক দূষণ কোনো একক ব্যক্তি বা দেশের সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক দুর্যোগ। তবে এর সমাধান শুরু হতে পারে প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজ থেকে। ব্যক্তি সচেতনতা, সরকারি নীতি এবং সামাজিক আন্দোলনের সমন্বয়ে চাইলেই এই ভয়াবহ দূষণ থেকে দেশ ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করা সম্ভব।

মন্তব্যসমূহ